দেশে আড়াই কোটির বেশি মানুষ অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। অথচ এটি সহজে শনাক্ত করে ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। রোগটি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হৃদরোগ, স্ট্রোক, হার্ট ফেইলিওর, কিডনির জটিলতার মতো গুরুতর অসংক্রামক রোগ এড়ানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ২১ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। এদের মধ্যে নিয়মিত ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে মাত্র ১৪ শতাংশ।
চিকিৎসকরা বলছেন, উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা না করা হলে ধমনি ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এমনকি ধমনি শক্ত হয়ে হিপণ্ডে রক্ত ও অক্সিজেনের প্রবাহ কমে যেতে পারে। ফলে বুকে ব্যথা বা অ্যানজাইনা, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট বিট অনিয়মিত হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে মস্তিকে রক্তক্ষরণ, অর্থাৎ স্ট্রোক হতে পারে। এ ছাড়া কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত, এমনকি বিকল হয়।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে (২০১৭-১৮) দেখা গেছে, দেশে ১৮ বছরের বেশি বয়সী ২৭.৩ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। আক্রান্তদের ৫৯ শতাংশ জানেনই না যে তাঁরা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। আক্রান্তদের ৩৬ শতাংশ এই রোগের চিকিৎসা নেন বা ওষুধ সেবন করেন। তাঁদের মাত্র ১২ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকতে দেখা গেছে। অর্থাৎ আড়াই কোটির বেশি মানুষ অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে দিন কাটাচ্ছে।
বাংলাদেশ কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিভাগের অধ্যাপক এস এম মুস্তাফা জামান বলেন, ‘উচ্চ রক্তচাপ মূলত তিন ধরনের হয়ে থাকে। একটি প্রাথমিক। এর কোনো কারণ জানা যায় না। বয়স্কদের এটি বেশি হয়। কিন্তু আমরা কম বয়সের রোগীও পাচ্ছি। যাদের অল্পবয়সে উচ্চ রক্তচাপ হয়, এর সঙ্গে কারণ জড়িত থাকে, যেমন—কারো কিডনি ছোট হয়ে গেছে, কারো হরমোনের সমস্যা অথবা রক্তনালি সরু হয়ে গেছে, থাইরয়েড সমস্যা, পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের সমস্যা, মস্তিষ্কে কোনো সমস্যা এমন। এ ধরনের রোগী কম পাওয়া যায়।
এমন পরিস্থিতিতে রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে সারা বিশ্বের মতো আজ ১৭ মে দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার তত্ত্বাবধানে ওয়ার্ল্ড হাইপারটেনশন লিগ ও ইন্টারন্যাশনাল হাইপারটেনশন সোসাইটি এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে—‘সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপুন, নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং দীর্ঘজীবী হোন’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ১২৮ কোটি মানুষ (৩০-৭৯ বছর) উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে, যার দুই-তৃতীয়াংশ বাস করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে। প্রতিবছর মৃত্যু হয় এক কোটিরও বেশি মানুষের, যা সব সংক্রামক রোগে মোট মৃত্যুর চেয়েও বেশি।
৬৪% রোগী কোনো ওষুধ সেবন করে না : বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৭-১৮ অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে, ৩৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ উল্লেখ্যযোগ্য হারে বেড়েছে। পুরুষের মধ্যে ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৪ শতাংশে এবং নারীর ক্ষেত্রে এই হার ৩২ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা রয়েছে, এমন নারী ও পুরুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার হার যথাক্রমে ৪৯ ও ৪২ শতাংশ, যেখানে স্বাভাবিক ওজনের নারী ও পুরুষের মধ্যে এই হার যথাক্রমে ২৫ ও ২৪ শতাংশ।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ : সরকার অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বহুখাতভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২৫ তৈরি করেছে, যেখানে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অনুসরণ করে ২০২৫ সালের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে ২৫ শতাংশ কমানোর জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ ব্যবস্থাপনায় জাতীয় গাইডলাইন এবং এর চিকিৎসায় ন্যাশনাল প্রটোকল প্রণয়ন করা হয়েছে।
এই গাইডলাইন তৈরির সঙ্গে ছিলেন অধ্যাপক এস এম মুস্তাফা জামান। তিনি বলেন, বর্তমানে ২৯৯ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিনা মূল্যে উচ্চ রক্তচাপের তিন ধরনের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মানুষ এ বিষয়ে জানে না। এ নিয়ে কোনো প্রচারও নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এনসিডিসি শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, এ বছর ১০০ কোটি টাকার ওষুধ বিনা মূল্যে দেওয়া হবে। গত বছর দেওয়া হয়েছে ৯৯ কোটি টাকার ওষুধ।
শহরে চারজনে একজনের উচ্চ রক্তচাপ : শহরে বাস করা মানুষের মধ্যে প্রতি চারজনে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। ১৪ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তের ঝুঁকিতে আছে। নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষের ওপর করা এক সমীক্ষায় এই তথ্য পাওয়া গেছে। মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা নির্ণয় ও ঝুঁকি যাচাইয়ে এ সমীক্ষা পরিচালনা করে বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে গবেষণার এসব তথ্য প্রকাশ করে সংস্থাটি।
স্কুলগামী ১৬.২% শিক্ষার্থীর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের ব্যাপকতা : স্কুলগামী কিশোর-কিশোরীর উচ্চ রক্তচাপের ব্যাপকতা এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত ঝুঁকির কারণগুলো জানতে ২০২২ সালে গবেষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।
গবেষণায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের ব্যাপকতা ছিল ১৬.২ শতাংশ, যার মধ্যে ছেলেদের ২৩.৬ শতাংশ ও মেয়েদের ৯ শতাংশ। এসব কিশোর-কিশোরী প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় বসে কাটায় এবং তাদের স্থূলতা (বডি মাস ইনডেক্স) বেড়েছে। তাদের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেশি ছিল। এ ছাড়া কম কায়িক পরিশ্রম করা কিশোর-কিশোরী উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার তীব্র ঝুঁকিতে থাকে।
দৈবচয়নের মাধ্যমে শহরতলির দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত দশম শ্রেণির ৮২৩ জন শিক্ষার্থী নির্বাচন করা হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর ডান হাত থেকে তিনবার করে রক্তচাপ পরিমাপ করা হয়েছে এবং সিস্টোলিক ১৩০, ডায়াস্টোলিক ৮০ উচ্চ রক্তচাপ হিসেবে ধরা হয়েছে।
সুত্র: কালেরকন্ঠ
পাঠকের মতামত